শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৩:০১ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
প্রতারণায় কম নয় কিউকম

প্রতারণায় কম নয় কিউকম

স্বদেশ ডেস্ক: প্রতিষ্ঠানের বয়স মাত্র দেড় বছর। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেই অবিশ^াস্য উত্থান কিউকম নামের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের। প্রথম দিকে নিয়ম মেনে ব্যবসা করলেও গত এক বছর ধরে চলছে চটকদার অফারের ব্যবসা। অবিশ^াস্য ঘটনা হচ্ছে এ দেড় বছরে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ব্যানারে। তবে এখন বিপুলসংখ্যক গ্রাহককে পণ্য বা টাকা ফেরত দিতে পারছে না। পথে বসার উপক্রম হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও এসব গ্রাহক কিউকম কর্তৃপক্ষের লাগাম পাচ্ছেন না। ইতোমধ্যে অফিস বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গ্রাহকরা হাহাকার করলেও
সদুত্তর নেই প্রতিষ্ঠানের। ফোন ধরছেন না গণমাধ্যমকর্মীদেরও।
মূলত চটকদার বিজ্ঞাপন আর বিশাল ছাড়েই গ্রাহক জোগাড় করত কিউকম। কিউকমের প্রতিষ্ঠাতা রিপন মিয়া পড়াশোনা করেন মালয়েশিয়ায়। পাশাপাশি জেমআর নামের একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন টিভি নাটক তৈরি করতেন। এ প্রতিষ্ঠানেই ইভ্যালির বিনিয়োগে অনেক নাটক তৈরি করেছেন তারা। ইভ্যালির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ রাসেলের সঙ্গে সখ্যতার সুবাদে রিপন মিয়া শুরু করেন ই-কমার্স ব্যবসা। অনেকটা ইভ্যালির আদলে তৈরি এ প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির মতোই আটকে রেখেছেন বহু গ্রাহকের টাকা।
মালয়েশিয়ার পুত্রা ইউনিভার্সিটিতে মার্কেটিং নিয়ে পড়াশোনা করেন রিপন মিয়া। ২০১৯ সালের শুরুতে দেশে ফিরে আসেন। যদিও কাগজে-কলমে তিনি পুত্রা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেলের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে দেশে ফিরেই ইভ্যালির সঙ্গে কিছুদিন কাজ করেন। এর পর নিজেই নেমে পড়েন ব্যবসায়। তৈরি করেন কিউকম।
দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনা এসব প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে এরা পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করে অন্য খাতে। এটা প্রতারণার শামিল।
তিনি বলেন, এরা মিথ্যা আশ^াস দিয়ে ব্যবসা করছে। নামিদামি তারকারা ব্যবহৃত হচ্ছে। এদের বিষয়েও সতর্ক হওয়া দরকার। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো মিথ্যা কন্টেন্ট এবং প্রতিশ্রুতি যেন না দেয় সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। এ প্রতারণার জাল থেকে গ্রাহকদের রক্ষার জন্য দরকার ই-কমার্স অথরিটি।
তিনি বলেন, এ ছাড়া আইন করে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। কারণ অনেকেই রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স না নিয়েই ব্যবসা করছে। ক্লোজ মনিটরিং করতে হবে এসব কার্যক্রম।
পুরো দেশ আর দুনিয়াজুড়ে কিউকম ছড়াতে চাই, ২১ দিনের মধ্যে ডেলিভারি, ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়, ৮ বিভাগে নিজস্ব ডেলিভারি পয়েন্ট, ওয়ারহাউস, কাস্টমার কেয়ারÑ নিজের ফেসবুক পেজ, ই-কমার্সের পেজে এমনই নানা চটকদার স্ট্যাটাস আর নিউজের মাধ্যমে কাস্টমারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিউকম। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নিতেন নানা পুরস্কারও। দেশসেরা ই-কমার্সের তকমা প্রচার করতেন কাস্টমারদের মধ্যে। এভাবে আস্তে আস্তে গ্রাহকদের কাছে বিশ^াসযোগ্যতা অর্জন করেন। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ হুমায়ুন কবির নিরব (আর জে নিরব) পিআর অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স ডিরেক্টর হিসেবেও চালাতেন নানা প্রচারণা। গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে নানা চটকদার ছাড়ের ঘোষণাও থাকত।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে প্রায় সাড়ে সাত লাখ গ্রাহক কিউকম থেকে নানা ধরনের পণ্য ক্রয় করেছেন। এর মধ্যে বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ গ্রাহকের পণ্য আটকে আছে কিউকমে। তবে আটকে থাকা গ্রাহকরা বেশিরভাগই অর্ডার করেছেন অপেক্ষাকৃত বেশি মূল্যের পণ্য। এর মধ্যে রয়েছে টেলিভিশন, ফ্রিজ ও মোটরসাইকেল।
প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিউকমের সিইও রিপন মিয়ার জেএমআর এন্টারটেইনমেন্ট নামের একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আগে ইভ্যালির স্পন্সরে বিভিন্ন নাটক বানাতেন তারা। তবে গত দেড় বছর ধরে কিউকমের স্পন্সরেই তারা নাটক বানানো শুরু করেন। গ্রাহকে পণ্য বা টাকা ফেরত না দিয়ে নাটক বানানো ও অন্য ব্যবসায়ও ইনভেস্ট করেন তারা। কয়েকজন জানান, মালয়েশিয়াতেও রিপন মিয়ার বিনিয়োগ রয়েছে।
কিউ ফর কোরআন। ছপড়ড়স.পড়স-এর নামের কারণ। পবিত্র কোরআনের প্রতি মানুষের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানের নামকরণের ব্র্যান্ডিং করতেন। এ ছাড়া মাত্র ২১ দিনে ডেলিভারিসহ নানা চটকদার বিজ্ঞাপনও থাকত। বিগবিলিয়ন অফার, স্বাধীনতা অফার, ধামাকা অফার এমন নানা নামে অফারের মাধ্যমে গ্রাহককে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হতো। এ ধরনের অফারে ৭৫ ভাগ মূল্য ছাড়েরও ঘোষণা থাকত। ফলে স্বল্পমূল্যে পণ্য পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন গ্রাহকরা।
এদিকে গ্রাহকরা পণ্য বা টাকা ফেরত না পেয়ে নানা মাধ্যমে হা-হুতাশ করছেন। এসবের মধ্যেই অফিস বন্ধ করে কর্মীদের হোম অফিস করার ঘোষণা দিয়েছে কিউকম কর্তৃপক্ষ। ফলে বিপুল পরিমাণ ক্রেতা তাদের টাকা ফেরত পাওয়ার উপায় নিয়ে অন্ধকারে রয়েছেন। তারা আশঙ্কা করছেন, আইনের আশ্রয় নিলে কিউকম কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার হবেন, কিন্তু টাকা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে। তাই এ মুহূর্তে তারা আইনের আশ্রয় নিতেও পারছেন না। নানাভাবে চেষ্টা করছেন পণ্য বা টাকা ফেরত পেতে। রাকিবুল ইসলাম নামের একজন গ্রাহক বলেন, নিকটাত্মীয়সহ পরিবারের জন্য ১১টি অর্ডারে প্রায় সাত লাখ টাকার পণ্য অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও পণ্য বা টাকা ফেরত পাচ্ছি না। এখন পরিবারের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না। আইনের আশ্রয় নিলে টাকা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা তো নেই।
পণ্য ফেরত না পাওয়ায় গ্রাহকরা ক্ষোভ ঝাড়ছেন কিউকমের বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ ও পেজেও। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী রিপন মিয়ার বিভিন্ন স্ট্যাটাসে শত শত ভুক্তভোগী গ্রাহক তাদের পণ্য বা টাকা ফেরতের আর্জি জানান। জানা যায়, কেবল কিউকমের পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং করা হয় গ্রাহকের কাছে। এতে কিউকমের প্রতি আস্থা জন্মায় সাধারণ গ্রাহকের। এর মধ্যে রয়েছে নারীদের রাইড শেয়ারিং অ্যাপস পিকমি, লজিস্টিকস কোম্পানি চররপশসব ঊীঢ়ৎবংং।
মনিরুল ইসলাম নামে এক গ্রাহক রিপন মিয়ার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘স্যার আমার ৩১ আগস্ট চেকের ডেট ছিল। জমা দিয়েছিলাম। টাকা জমা হয় নাই। পরে আপনাদের ডেট চেঞ্জ করে। ১৩ সেপ্টেম্বর ঘোষণা দেওয়া হলো। এখন আবার বলতেছেন বুধবারের পরে। স্যার একজেক্টলি বলা যায় কত তারিখে পাব?’ নয়ন সাহা নামে আরও একজন লেখেন, ‘কুইকার-২ ক্যাম্পেইনে বাইক অর্ডার করেছি ৭ জুলাই। কিন্তু এখনো পেন্ডিং দেখায়, কাস্টমার কেয়ারে অনেকবার কথা বলেছি প্রতিবারই বলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু কোনো সমাধান নেই। এখন কী করতে পারি?’ গ্রাহক আবু সায়েম শান্ত লিখেছেন, ‘ফ্রিজ আর ব্লেন্ডার অর্ডার করেছিলাম। তিন মাস হয়ে গেছে। কবে পাব?’ এমন শত শত গ্রাহক বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছেন পণ্য ফিরে পেতে। প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকটি কাস্টমার কেয়ার নম্বর থাকলেও কেউ ফোন ধরছে না। ফলে গ্রাহকরা প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা নিয়েই সময় পার করছেন।
এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হয় কিউকমের প্রধান নির্বাহী রিপন মিয়াকে। তার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। প্রতিবেদকের পরিচয় ও প্রশ্ন লিখে খুদেবার্তা পাঠালেও দেননি প্রতিউত্তর। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। প্রতিষ্ঠানটির পিআর অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স পরিচালক হুমায়ুন কবির নিরব (আর জে নিরব) বলেন, ‘আমরা যে ফরমেটে ব্যবসা করছিলাম তা আইনে বদল হয়ে গেছে। অথচ আমাদেরকে সময় দেওয়া হয়নি। এখন আমরা ভোক্তাকে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার অনেক পরে টাকা পাই। আমরা পণ্য গেটওয়েকে দেওয়ার অনেক পরে বিল পাই এবং সেটা কখনো কখনো কয়েক মাস লেগে যায়। একটা সময় ছিল তারা আগে বিল দিয়ে পণ্যটি ক্রয় করত, এখন তার উল্টোটা হচ্ছে। ফলে আমরা ব্যবসা কুলিয়ে উঠতে পারছি না। অথচ পৃথিবীর সব বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পণ্য কিনতে চাইলে আগে পে করতে হয়। তা নিয়ে কিন্তু কোনো কথা হয় না। আমাদেরকে যে ফরমেটে বেঁধে দেওয়া হয়েছে তা অমানবিক। অন্তত কয়েকটা মাস সময় দিতে পারত নতুন আইন করার আগে। অন্তত এটা বলতে পারত যে, যা করেছ ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট দিনের পর থেকে আর এভাবে ব্যবসা করা যাবে না।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877